প্রকৃতির বীণায় কে যেন গো সুর বেঁধে দিয়েছে। কেউবা কী নেশার টানে বনে বনে ফুলেল আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে। বনানী জুড়ে নব পল্লবের জয়গান। বাংলা প্রকৃতি এখন স্নিগ্ধময়ী, বাসন্তী বাস পরা। শীতের জরাগ্রস্থতা কাটিয়ে নতুন পাতায় ঋব্ধ হয়ে উঠছে রিক্ত বৃক্ষাদি। বেশুমার বনফুল হতে গুনগুন রবে মৌ-পরাগ আহরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মধুমক্ষিকার দল। বিচিত্র সব মুকুলের মদির সুবাসে মানব মন মাত্রই অন্যরকম হিন্দোলিত হয়ে উঠছে। আদিগন্ত ফাগবেশ আর ব্যঞ্জনাময় উৎসব আমেজ মোহাবিষ্ট করে দারুণভাবে। এই জন্যই বসন্তের মাথায় স্মরণাতীতকাল ধরে ঋতুরাজ তথা ঋতুশ্রেষ্ঠর মুকুট।
‘হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়, বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?- বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা কবির থাক বা না থাক আজ পহেলা ফাল্গুন। ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। প্রকৃতির চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী বন-বনান্তে কাননে কাননে পারিজাতের রংয়ের কোলাহলে ভরে উঠেছে চারদিক। কচি পাতায় আলোর নাচনের মতোই বাঙালির মনেও লেগেছে রংয়ের দোলা। হৃদয় হয়েছে উচাটন।
‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।/তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/কোরো না বিড়ম্বিত তারে।’—এভাবেই ঋতুরাজ বসন্তের বন্দনা করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বসন্ত উপলব্ধি করেছেন এভাবে—‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক/আজ বসন্ত।’ হ্যাঁ, গাছের শাখার শাখায় রঙিন ফুলের পসরা সাজিয়ে, ঝরিয়ে দিয়ে মলিন পাতার রাশি, আজ বুধবার আবার এলো পহেলা ফাল্গুন, আজ বসন্তের প্রথম দিন।
বসন্ত মানেই নতুন সাজে প্রকৃতি মুখরিত হওয়ার দিন। ফুল ফোটার পুলকিত সময়। শীতের জরাগ্রস্ততা কাটিয়ে নতুন পাতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠবে রুক্ষ প্রকৃতি। ফাগুনের ঝিরঝিরে বাতাসে কোকিলের মিষ্টি কলতানে উন্মাতাল হবে প্রকৃতি। ফুলেল বসন্ত যৌবনের উদ্দামতা বয়ে আনে। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসমুখরতায় মন-প্রাণ ভরিয়ে তোলে।
পাতার আড়ালে আবডালে লুকিয়ে থাকা বসন্তের দূত কোকিলের মধুর কুহুকুহু ডাক, ব্যাকুল করে তুলবে অনেক বিরহী অন্তর। কবি তাই বলেছেন ‘সে কি আমায় নেবে চিনে/ এই নব ফাল্গুনের দিনে…’। তবে বসন্তের সমীরণ বলছে এ ঋতু সব সময়ই বাঙালির মিলনের বার্তা বহন করে।
ইতিহাসঃ বাংলার এই অঞ্চলে, প্রাচীন আমল থেকেই বসন্ত উৎসব পালিত হচ্ছে। হিন্দুদের পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলোতে এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। হিন্দু বৈষ্ণবরা এটি বেশ আয়োজনের সাথে পালন করে থাকেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি চলে আসছে। বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব নিয়মিত আয়োজন করে আসছে।
পয়লা ফাল্গুন বা পহেলা ফাল্গুন বাংলা পঞ্জিকার একাদশতম মাস ফাল্গুনের প্রথম দিন ও বসন্তের প্রথম দিন। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৩ই ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন পালিত হয়। বসন্তকে বরণ করে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশায় সহ অন্যান্য রাজ্যে দিনটি বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। বাংলাদেশে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ এই দিনকে বরণ করতে চারুকলার বকুলতলায় এবং ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিবছর জাতীয় বসন্ত উৎসব আয়োজন করে।
‘পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে/ এসেছে দারুণ মাস।’- কবিতার মতো করেই বাংলা প্রকৃতিতে এসেছে ঋতুরাজের প্রথম মাস। হ্যাঁ, আজ বুধবার পহেলা ফাল্গুন। বাংলা পঞ্জিকা বর্ষের শেষ ঋতু বসন্তেরও হলো শুরু। তাই তো দিকে দিকে চলছে বর্ণিল, পার্থিব-অপার্থিব নানা আয়োজন। এর কাব্যরূপ- ‘আহা, আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোটে কত বাঁশি বাজে কত পাখি গায়…।’
ভূগোলবিদ ও পঞ্জিকা বিশারদরা ঈসায়ী বর্ষের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারি ও বঙ্গাব্দের একাদশ মাস ফাল্গুনের সাথে মৈত্রী তৈরি করে দিয়েছেন। তাই ঈসায়ী বর্ষ ‘অধিবর্ষ’ হলে ঐ বছর ফেব্রুয়ারি একদিন বেড়ে ঊনত্রিশ দিনে হয় এবং একই সময়ে ফাল্গুন মাসও ত্রিশ দিন থেকে বেড়ে একত্রিশ দিনে হয়। এ বছর এমনটিই হচ্ছে। ফাল্গুন পেরিয়ে বসন্ত তার যৌবনের চৌকাঠ মাড়িয়ে চৈত্রে পদার্পণ করবে। ফাল্গুন মাসের নাম ‘ফাল্গুনী’ তারা আর চৈত্র মাস ‘চিত্রা’ তারার নামের সঙ্গে মিল রেখে রাখা হয়েছে। এ সময় মহান আল্লাহপাকের অপার সৃষ্টি মহিমায় দক্ষিণ গোলার্ধ পরিভ্রমণ শেষে সূর্য তার কক্ষপথে উত্তর-অভিমুখে ধাবিত হতে থাকে। আপনা হতেই প্রকৃতিতে লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। উত্তরী বায়ুর যাত্রাপথ রুদ্ধ হয়ে দখিনা মৃদুমন্দ সমীরণ লহর তোলে। তরুলতা পুরানো পাতা ঝেড়ে ফেলে নববধূরূপে মুকুলিত হয়। পত্রপল্লবে সুশোভিত হয় সবুজ উদ্যান। সত্যিই বসন্তের আমোদনে ফাল্গুনের ঝিরি ঝিরি হাওয়া, নির্মেঘ রোদ্দূর নতুন মাত্রা যোগ করে নিসর্গে। কোকিলের কুহুতান তো বসন্তেরই মর্মগান।
ফাল্গুন আসার আগেই অবশ্য আমমঞ্জরী কোষগুলো পরিণত হতে থাকে। কাঁঠাল গাছের শাখায় শাখায় ধরে মুছি (মুকুল)। লিচু গাছগুলোও ফলবতী হয়ে উঠেছে এর চেয়েও বেশি বসন্তকে উপলব্ধি করা যায় রক্তিম পলাশ, শিমুল, কাঞ্চন, পারিজাত, মাধবী, গামারী আর মৃদুগন্ধের ছোট ছোট বরুণ ফুলে। এছাড়া গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়াসহ হাজারো নামের বর্ণালী ফুল তো বসন্তের সাজ আভরণ হিসেবেই বিবেচ্য। পŠষ-মাঘের জরা-ব্যাধির আসর এসে পড়ে পরের মাসেও। গরম অনুভূত তথা ঋতু বদলের বাতাস বইতে না বইতে ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, পানিবসন্ত ইত্যাদি রোগ দেখা দেয়। চিকিৎসকেরা এ সময়ে সর্বসাধারণকে সচেতন হয়ে চলার পরামর্শ দেন।
খুব বেশি না হলেও কৃষির সাথে ফাল্গুনের যোগসূত্র রয়েছে। ‘যদি বর্ষে ফাল্গুনে/ চীনা কাউন দ্বিগুণে’, ‘ফাল্গুনে গুড় আদা বেল পিঠা/ খেতে বড় মিঠা’ এমনি আরও অনেক কৃষিবিষয়ক খনার বচন রচিত হয়েছে বাংলা বর্ষের একাদশ মাসকে ঘিরে। কৃষক ফাল্গুনের দেয়ালে পিঠ রেখে তাকিয়ে থাকে চৈতালী ফসলের দিকে। এই ফাল্গুনেই দিগন্তজোড়া মাঠের বোরো ধান সোনালি রূপ পেতে থাকে। ফাল্গুনের স্বরূপ কবি-সাহিত্যিক, চিত্রকর, সঙ্গীতশিল্পী, সাংবাদিক সকলকেই মুগ্ধ করে। ফাল্গুন তথা বসন্তকাল এলে গ্রাম থেকে নগর-আবহমান বাংলার সর্বত্রই মেলার মওসুমও শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)-এর ১৩৯০ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের মেলা’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, গোটা বসন্তে মোট ৩২২টি গ্রামীণ মেলা বসে। এর মধ্যে ফাল্গুনে ৭৩টি ও চৈত্রে ২৪৯টি মেলা। এগুলোয় বসে দোলযাত্রা, চৈত্র তিথি, বারণী, চৈত্র সংক্রান্তি ইত্যাদি বিশেষ উপলক্ষে। মেলাকে ঘিরে প্রতিটি জনপদে উৎসবের জোয়ার বয়ে যায়। এসব মেলার মেয়াদকাল এক থেকে সাতদিন পর্যন্ত। লোক-কারুশিল্প পণ্য ছাড়াও এসব মেলায় বাহারী পসরা বসে। আধুনিক ব্যবহার্য ভোগপণ্যও বাদ যায় না। রাজধানীতে চলছে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ঢাকার বাইরেও বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে।
এর বাইরে ফাল্গুনের আরেক পরিচয় ভাষা শহীদদের তপ্তশোতিক্ত মাস। ঊনিশশ’ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ আটই ফাল্গুন মাতৃভাষা ‘বাংলা’ প্রতিষ্ঠার জন্য রফিক, সালাম, জববার প্রমুখ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। বারবার ফিরে আসে ফাল্গুন, আসে বসন্ত। শোক নয়, সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী মোকাবিলার দুর্বিনীত সাহস আর অপরিমেয় শক্তি নিয়ে। বীর সন্তানদের অমর গাঁথা নিয়ে। যে কোন বিচারে এ এক অনন্য মাস, ঋতু। নৈসর্গিক ক্যানভাসে রক্তাক্ত বর্ণমালা যেন এঁকে দেয় অনির্বচনীয় সুন্দর এক আল্পনা। প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে উদার সড়কের বুকে। দেয়ালগাত্র থেকে লোহিত ধারার মোহনা শহীদ মিনার পর্যন্ত। আজ পহেলা ফাল্গুনে পাশ্চাত্য অনুকরণপ্রিয় তরুণ-তরুণীরা বেসামাল উন্মাদনায় মেতে উঠবে।
-
Previous Post
আরব বসন্ত