ভুমিকাঃ
আরব বসন্ত নামে যে দমকা হাওয়া উলট-পালট করে দিয়েছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে, সেই মাতাল বসন্ত হাওয়ার পরাগায়ন সমৃদ্ধ ফুল পূর্ণ সৌন্দর্যে আজ বিকশিত হচ্ছে তিউনিসিয়ায়।
প্রায় চার বছর আগে সবজি বিক্রেতা বু আজিজির আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে তিউনিসিয়া থেকেই প্রথম শুরু হয়েছিলো আরব জাগরণ।আর জাগরণের ধাক্কায় টালমাটাল হয় আরব বিশ্বের দেশগুলোতে যুগ যুগ ধরে চলে আসা স্বেচ্ছাচারী শাসনের ভিত্তিমূল।
তবে আরব জাগরণের ধাক্কায় আরব দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন কতটুকু তা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ হলেও, বিপ্লবের জননী হিসেবে পরিচিত তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের ফুল কিন্তু ঠিকই ফুটছে পূর্ণ বিকশিত রূপে।
‘আরব বসন্তে’র দোলায় মধ্যপ্রাচ্য অস্থিরতা ছড়িয়েছে কিন্তু স্থিতিশীলতা কিংবা সমৃদ্ধি আসেনি। মিসরে এক সরকারকে হটিয়ে আরেক সরকার সিংহাসনে বসেছে, লিবিয়া জুড়ে চলছে বিশৃঙ্খলা, গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ে মরছে সিরিয়া, দেশটির লাখ লাখ মানুষ ঘর ছেড়ে এখন খোলা আকাশের নিচে ঘুরছে। বাস্তবতা হচ্ছে ‘আরব বসন্ত’টা হলো পশ্চিমাদের রং দেয়া ‘রং বিপ্লব’ এর মহড়া।
স্নায়ু যুদ্ধ চলাকালে পশ্চিমাদের ইন্ধনেই ভেঙে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর সে সময়টাতেই পশ্চিমারা ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শাখা মেলার সুযোগ তৈরি করে।কিন্তু রাশিয়ার পুর্নজাগরণে তাদের এ যুদ্ধ ভেস্তে যায়। রাশিয়াকে বাদ দিয়ে পশ্চিমারা তাদের নজর ফেরায় মধ্যপ্রাচ্যের দিকে।
২০১১ সালটাতে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ও দ্বন্দ্ব বিস্তার লাভ করে। আর এ সুযোগটাকে মোক্ষম সময় হিসেবে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের কাজে লাগায় পশ্চিমারা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ছড়িয়ে আন্দোলন ও বিক্ষোভকে ‘আরব বসন্ত’ বলে প্রচার করে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো। আর এসব আন্দোলনে পশ্চিমা সরকারেরা হস্তক্ষেপ করে এবং তাদের স্বার্থের বিষয় মাথায় রেখে মধ্যপ্রাচ্যে উন্নয়ন কাজে বিনিয়োগ করে।
চলমান বিক্ষোভ ও আন্দোলনের মুখে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ না করে বরং তারা বিশৃঙ্খলার বীজই বপন করে যাচ্ছে।পশ্চিমাদের তৈরি করা ‘আরব বসন্ত’ কোন রদ-বদলতো আনতেই পারেনি বরং আরেক সংকটে পড়েছে মিসর, লিবিয়া ও সিরিয়া।
আরব বসন্ত কি?
২০১০ সালের শুরু থেকে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বয়ে যাওয়া গণবিপ্লবের ঝড়কে পশ্চিমা সাংবাদিকরা আরব বসন্ত হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। গণবিক্ষোভের শুরু মিশরে; এরপর তা লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন সহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। প্রথমে মিশরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পতন হয়। পরে লিবিয়ায় মুয়াম্মর আল-গাদ্দাফি জামানার অবসান হয়। আরব বিশ্বের এই গনঅভ্যূত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এর ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত সহচর রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র সরবরাহ করে এবং সরাসরি আঘাত হেনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়কের পতন ঘটায়। এক হিসাবে বলা হয় আরব বসন্তের ফলে মাত্র পৌনে দুই বছরে লিবিয়া, সিরিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেনের গণ-আন্দোলনের ফলে মোট দেশজ উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে দুই হাজার ৫৬ কোটি ডলার।[২] ডিসেম্বর ২০১০ থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় যে গণ বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন হচ্ছে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। এ পর্যন্ত আলজেরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, মিশর, ইরান, জর্ডান, লিবিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়ায় বড় ধরণের বিদ্রোহ হয়েছে এবং ইরাক, কুয়েত, মৌরিতানিয়া, ওমান, সৌদি-আরব, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়াতে ছোট আকারের ঘটনা ঘটেছে। এসব বিদ্রোহে প্রতিবাদের ভাষারূপে গণবিদ্রোহের অংশ হিসেবে হরতাল, বিক্ষোভ প্রদর্শন, জনসভা, র্যালি প্রভৃতি কর্মসুচী নেয়া হয়। দেশব্যাপী সাংগঠনিক কাজ, যোগাযোগ এবং রাষ্ট্রীয় প্রচারণার থেকে জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে ফেসবুক, টুইটারের মত সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ব্যবহৃত হয়। এরই মধ্যে তিউনিসিয়া, মিশরে বিদ্রোহের ফলে শাসকের পতন হয়েছে বলে এখানে তা বিপ্লব বলে অভিহিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন কারণে এমন বিদ্রোহের সূচনা হয় যার মধ্যে সরকারি দুর্নীতি, স্বৈরতন্ত্র, মানবাধিকার লংঘন, বেকারত্ব এবং চরম দারিদ্র্যের অভিযোগের পাশাপাশি বিশাল যুবসমাজের অংশগ্রহণও অনুঘটকরূপে কাজ করেছে। এর পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং খরার প্রকোপও বড় কারণ।
১৮ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ায় মোহাম্মদ বোয়াজিজির পুলিশে দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারে প্রতিবাদে আত্মাহুতির মাধ্যমে বিদ্রোহ শুরু হয়। তিউনিসিয়ার বিপ্লব সফল হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য দেশেও আত্মাহুতির কারণে অস্থিরতা শুরু হয় যার ফলে আলজেরিয়া, জর্ডান, মিশর ও ইয়েমেনে বিদ্রোহ শুরু হয়।
তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপ্লবের ফলে ১৪ জানুয়ারি শাসক জেন এল আবেদিন বেন আলির পতন ঘটে এবং তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। ২৫ জানুয়ারি থেকে মিশরে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ১৮ দিনব্যাপী বিদ্রোহের পরে ৩০ বছর ধরে শাসন করা প্রেসিডেন্ট মুবারক ১১ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন। একই সাথে জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ নতুন প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেন; ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি আলি আব্দুল্লাহ সালেহ ঘোষণা দেন যে তিনি ২০১৩ সালের পর আর রাষ্ট্রপতি থাকবেন না যা তখন ৩৫ বছরের শাসন হবে। বর্তমানে লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে পতনের চেষ্টা হচ্ছে এবং সুদানের রাষ্ট্রপতি আলি আব্দুল্লাহ সালেহ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি ২০১৫ এর পর নির্বাচনে অংশ নেবেন না ।
এরূপ স্বতস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ এবং এসব দেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে তা আজ গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ।
আত্মাহুতিঃ
মোহাম্মদ বোয়াজিজির আত্মাহুতির পরে আরব বিশ্বে আরো অনেকগুলো আত্মাহুতির ঘটনা ঘটে। আলজেরিয়ায় মহসিন বৌটারফিফ শহরের মেয়রের সাথে একটি আলোচনায় ব্যর্থ হবার পর ১৩ জানুয়ারি, ২০১১ আত্মাহুতি দেন এবং ২৪ জানুয়ারি, ২০১১ মারা যান। মিশরে আব্দোউ আব্দেল-মোনেম জাফর ১৭ জানুয়ারি মিশরের সংসদের সামনে আত্মাহুতি দেন। সৌদি আরবে একজন ৬৫ বছর বয়সী অজ্ঞাত ব্যক্তি ২১ জানুয়ারি আত্মাহুতি দেন ও মারা যান ।
পটভূমিঃ
স্বৈরাচার বা চরম রাজতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ( উইকিলিকসের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া বিভিন্ন ফাইল ), দুর্বল অর্থনীতি, বেকারত্ব, চরম দারিদ্র্য ও শিক্ষিত হতাশাগ্রস্থ যুবসমাজ ইত্যাদি কারণে এইসব এলাকায় বিক্ষোভের সূচনা হয়। এছাড়াও এসব দেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে থাকায় তারা কয়েক দশক ধরে ক্ষমতায় ছিল, সম্পদের সুষম বন্টন হয় নি, খরা ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
ইন্টারনেট দিয়ে শুরু করা আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত যেখানে স্বৈরতন্ত্র ও রাজতন্ত্রকে অচল বলে মনে করা হয়। এওসব দেশে সাম্প্রতিক কালে জীবনযাত্রার মান, শিক্ষার হার বৃদ্ধির কারণে মানব উন্নয়ন সূচক এর উন্নতি হয়েছে কিন্তু তার সাথে সাথে সরকারের সংস্কার হয় নি।
তিউনিসিয়া ও মিশরের অর্থনীতি তেলের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল ছিল না, যার ফলে সরকার বড় মাপের বিদ্রোহ দমনে ব্যার্থ হয়।
আরব বসন্তের শুরুঃ
২০১০-২০১১ তে আরবে আরব যুবকরা তাদের অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করলো যারা কিনা মধ্য প্রাচ্যে ১০০ বছরের বেশী সময় ধরে পশ্চিমা শাসন প্রতিষ্ঠা করে আসছে। এই বিদ্রোহের কারনে মুসলিম বিশ্বে অনেক পরিবর্তন দেখা যায়। এটি ভালোভাবেই জানা যে যদি সত্যিকারের গণতন্ত্র মুসলিম বিশ্বে স্থাপন করা হয়, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা ইসলামিক শাসন বাস্তবায়নের জন্য এমন একটি দলকে ভোট দিবে যারা তাদের দেশ থেকে পশ্চিমা আধিপত্য ও জায়নিস্ট ইহুদীদেরকে তাড়িয়ে দিতে চায়। ওই ১% (জায়নিস্ট), যারা কিনা পুরো বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং মুসলিমদের সম্পদগুলো লুট করে, তারা জানত যে মুসলিমরা যদি ইসলামিক নেতৃত্ব চায় তবে সেটা অনিবার্য হয়ে পড়বে, আর যদি ওই স্বৈরশাসন চলতে থাকে তবে মুসলিম জনতা বিদ্রোহ চালিয়ে যেতে থাকবে এবং এমনকি অস্ত্রও হাতে তুলে নিতে পারে ও মিসরকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে (যা কিনা ইসরায়েলের পাশেই)।
মিসর এবং বিদ্রোহ চলা অন্যান্য দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোট গ্রহনের এক আচমকা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (১০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে চলে আসা স্বৈরশাসনের পর)। নিজেদের মুখ রক্ষার জন্যই আমেরিকা এটি করেছিলো কারন পুরো বিশ্ব এই বিদ্রোহের খবর দেখছিল এবং যদি আমেরিকা ওই দেশগুলোর জনগনের নিজেদের নেতাকে খুজে নেওয়ার অধিকার সমর্থন না করত তাহলে তাদের ওই স্বৈরশাসনকে সমর্থন করার ব্যাপারে আমেরিকার ভণ্ডামি প্রকাশ হয়ে যেত।
মিসর, তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলোতে সংঘটিত নির্বাচনে ইসলামপন্থী সংঘটনগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভতে জয়লাভ করে। তারা ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড এবং এই ধরনের ইসলামপন্থী সংঘটন যারা গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল এবং একারনে তারাও পশ্চিমা অর্থনৈতিক কতৃত্ব ও চাপের নিচে ছিল।
মিশরের গণবিক্ষোভঃ
আরব বিশ্বে গণবিক্ষোভের শুরু মিশরে। মাত্র ১৭ দিনে পতন হয় প্রেসিডেণ্ট হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের প্রতাপশালী শাসন। ২০১০-এর শুরুতে ২৫শে জানুয়ারি প্রথম গণবিক্ষোভ ছিল মিশরীয় জনগণের দীর্ঘকালের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ। ১৭ দিন গণআন্দোলনের পর ১১ই ফেব্রুয়ারি হোসনি মোবারকের পতন হয়। ঐ দিন মিশরের সমস্ত মানুষ স্বৈরাচারি হোসনি মোবারকের অপসারণের দাবিতে গণবিক্ষোভে ফেটে পড়লে নব নিযুক্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সোলাইমান টেলিভিশন ভাষণে হোসনি মোবারকের ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবার ঘোষণা দেন। প্রেসিডেন্টের পদ থেকে হোসনি মোবারকের সরে দাঁড়ানোর খবর মিশরবাসী উল্লাসে ফেটে পড়ে। ১৯৮১ সালে হোসনি মোবারক ক্ষমতায় আসার পর থেকে মিশরে কার্যত সেনাবাহিন সমর্থিত একনায়কতন্ত্র সূচনা হয়। পশ্চিমা দেশগুলো যারা শুরু থেকেই হোসনি মোবারককে নি:শর্তভাবে সমর্থন দিয়ে আসছিল, ক্ষমতা থেকে মোবারকের সরে দাঁড়ানোর পদক্ষেপকে স্বাগত জানায়। মোবারক ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সামরিক উচ্চ পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন তানতাভি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। মূলত মিশরীয় সেনাবাহিনী মোবারকের পক্ষ ত্যাগ করে জনগণের পক্ষাবলম্ববন করার সিদ্ধান্ত নিলে দ্রুত পট পরিবর্তন ঘটে।
তিউনিশিয়ায় গণঅভ্যূথানঃ
মিশরে হোসনি মোবারকের পতনকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হয়েছিল। কিন্তু ২০১১-এর শুরুতে আফ্রিকার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি তিউনিশিয়ার গণঅভ্যূত্থানের ধারাবাহিকতাতেই যেন লিবিয়া, সিরিয়া, বাহরাইন প্রভৃতির গণ্যঅভ্যূত্থান। তিউনিশিয়ায় গণঅভ্যূথানে ২৪ বছরের একচ্ছত্র রাজত্বের “জাইন-এল আবেদিন বেন আলীর” পতন ঘটে। তিনি সৌদী আরবে পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করেন।
লিবিয়ায় গণবিক্ষোভঃ
লিবিয়ায় গণবিক্ষোভ চলে প্রায় ৯ মাস। ২০১১-এর ফেব্রুয়ারিতে গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ ও লড়াই শুরু হয়। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে দ্বিতীয় দেশের বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বেনগাজিতে একটি থানার কাছে শত শত জনতা গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। এতে সহিংসতায় বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। এ দিনটিকে ‘দ্য ডে অব রিভোল্ট’ বলা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি বেনগাজি শহর দখল করে নেয় বিদ্রোহীরা। এতে গাদ্দাফির অনুগত বাহিনী ও বিরোধীদের লড়াইয়ে কয়েক’শ মানুষ নিহত হয়। এর পরও গাদ্দাফির অনুগত বাহিনী বেনগাজি পুনরুদ্ধারে বেশ কয়েক সপ্তাহ লড়াই চালিয়ে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মার্চের ১০ তারিখে, গাদ্দাফি বাহিনী ব্রেগা শহরে বোমাবর্ষণ শুরু করে। বিদ্রোহীদের কাছ থেকে জায়িয়াহ ও বিন জাওয়াদ শহর পুনরুদ্ধার করে গাদ্দাফির সেনারা। এরপর ব্রেগা ও আজদাবিয়াহ শহরে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই চলে। ১৯শে মার্চ তারিখে পশ্চিমা বিশ্ব গাদ্দাফি পতনের লক্ষ্যে জন্য আক্রমণ চালায়। প্রথমে লিবিয়ায় বোমা নিক্ষেপ শুরু করে সামরিক জোট ন্যাটো। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিতর্কের পর লিবিয়ায় নো ফ্লাই জোন কার্যকরের প্রস্তাব পাস হয়। ১৫ সদস্যের পরিষদে স্থায়ী দুই সদস্যরাষ্ট্র রাশিয়া, চীনসহ পাঁচটি সদস্যরাষ্ট্র ভোটের সময় অনুপস্থিত থাকে। ১৫ই মে তারিখে গাদ্দাফি সাগর তীরের শহর মিসরাতা থেকে তাঁর বাহিনী প্রত্যাহার করে নেন। এর আগে কয়েক সপ্তাহ শহরটি অবরোধ করে রাখা হয়। সেখানে যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকসহ উভয় পক্ষের বহু সেনা হতাহত হয়। ১৫ই আগস্টে বিদ্রোহীরা রাজধানী ত্রিপোলির দিকে অভিযান শুরু করে। দ্রুত ত্রিপোলির ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের ঘরান এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় বিদ্রোহীরা। ২১শে আগস্ট তারিখে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয় বিদ্রোহী বাহিনী। রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে “গ্রিন স্কয়ারে” পৌঁছে বিদ্রোহীরা। তারা ওই স্কয়ারের নাম পরিবর্তন করে “শহীদ চত্বর” নাম দেয়। দুদিন পর ২৩শে আগস্ট গাদ্দাফির আবাসস্থল “বাব আল-আজিজিয়া”র পতন। তবে সেখানে গাদ্দাফি বা তাঁর পরিবারের কাউকে খুঁজে পায়নি বিদ্রোহীরা। সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে নাইজার জানায়, গাদ্দাফির ছেলে “সাদি গাদ্দাফি” সে দেশে প্রবেশ করেছে। ১৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে লিবিয়ার একমাত্র বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিদ্রোহীদের গঠিত “ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল”কে (এনটিসি) সমর্থন দেয় জাতিসংঘ। ১৭ই অক্টোবর গাদ্দাফির শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত “বনি ওয়ালিদ” দখল করতে সক্ষম হয় বিদ্রোহী বাহিনী। পরদিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এক ঝটিকা সফরে লিবিয়ায় যান। তিনি বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। অক্টোবর ২০: সিরত শহরে লড়াইয়ে নিহত হন গাদ্দাফি।
সিরিয়ার বিদ্রোহঃ
সিরিয়ার বিদ্রোহ হল একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ঘতে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা সমূহের মধ্যে একটি দুঃখজনক মোড়।
২০১১ সালে শুরু হওয়া আলাওয়ীদের (শিয়াদের একটি উপদল ) স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ব্যাপারে সিরিয়ার জনগণ যথেষ্ট সাহসী ছিল। ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে শুরু হওয়া আসাদ পরিবারের এই স্বৈরশাসন শুরু হয়েছিলো হাফিয আসাদকে দিয়ে এবং এখন তার ছেলে বাশার আল আসাদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছে। সিরিয়ার জনগণ তাদের অত্যাচারী শাসক আর গোপন পুলিশ (শাবিহা, যার অর্থ হল প্রেতাত্মা) দিয়ে নির্যাতিত হয়ে আসছিল এক দীর্ঘ সময় ধরে। সিরিয়ার জনগনের অর্ধেকেরও বেশী লোক ছিল বাশারের স্বৈরতন্ত্র রক্ষার কাজে নিয়োজিত গোয়েন্দা (তারা তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ভিত থাকার কারনে)। কোন মানুষকে যদি সামান্যও বিদ্রোহী, “অতিরিক্ত” ধার্মিক বা আসাদ-বিরোধি হিসেবে সন্দেহ করা হত, তখন তার পুরো পরিবারের লকজন ধরে নিয়ে এসে ধর্ষণ,কারারুদ্ধ,নির্যাতন, অঙ্গ-প্রত্তঙ্গ কেতে ফেলার মতো শাস্তি দেওয়া হতো এবং মেরে ফেলা হতো। এই স্বৈর শাসন আর আতঙ্ক সিরিয়াতে প্রায় ৫০ বছর ধরে (১৯৬৩-২০১২ +) টিকে আছে। হাজার হাজার সিরিয়ানদেরকে আলাওয়ী শিয়ারা ধর্ষণ ও হত্যা করেছিলো (এখনও করছে) যারা সংখ্যা গরিষ্ঠ সুন্নিদেরকে তাদের শত্রু মনে করে।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
“যখন শামের (সিরিয়া, জর্ডান, প্যালেস্টাইন) লোকেরা পথভ্রষ্ট হবে তখন তোমাদের মধ্যে কোন কল্যাণ থাকবে না। আমার উম্মতের মধ্য থেকে একদল লোক আল্লাহর সাহায্য পেতে থাকবে, যারা তাদের বিরোধিতা করবে তারা শেষ সময় পর্যন্ত তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।” (তিরমিযি ২/৩০ –নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত)
একইভাবে, শামের লোকেরা যখন ভাল হয়ে যাবে তখন মুসলিমদের বাকি অংশও ভাল হয়ে যাবে এবং সফল ও সমৃদ্ধ হবে।
যেহেতু পশ্চিমা শক্তি ও জায়নিস্ট্ররা মিসরের এই পরিবর্তনটি সাপোর্ট করেছিলো (২০ বছরের বেশী সময় ধরে চলা হোসনী মুবারকের স্বৈরতন্ত্রকে ২০১০-১১ এর পর গনতন্ত্রে পরিবর্তন করা) মিসরের জনগনের অভ্যুত্থানের কারনে, তাই একনায়কতান্ত্রিক বাশার আল আসাদকে সাপোর্ট করা তাদের জন্য একটি ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণ হিসেবে প্রকাশ হবে।। এর কারনে সিরিয়ার নির্যাতিত বিদ্রোহীদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকল এ আশায় যে বাশার আল আসাদের সরকার (যারা কিনা জায়নিস্ট ইসরাইলকে ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে রক্ষা করছিলো ) ওই অভ্যুত্থানকে দমন করতে পারবে।
শাবিহারা (সিরিয়ার গোপন পুলিশ ) শান্তিপূর্ণ মিছিলকারীদের উপর গুলি চালান শুরু করলো এবং তারা বিশ্বের অন্যান্য সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্য চাইল। কিন্তু বিশ্বের কোন শক্তিই তাদের সাহায্য করলো না। ধীরে ধীরে কিছু নিন্ম পদস্থ সিরিয়ান সৈন্য সেনাবাহিনী ছেড়ে দিয়ে যেসব অস্ত্রধারী বিদ্রোহী সুন্নিদের রক্ষা করছিলো তাদের শক্তি আরও বৃদ্ধি করলো। তখন সেই সশস্ত্র বিদ্রোহ ধর্মীয় যুদ্ধের দিকে গরাতে লাগলো এবং অস্ত্রধারী বিদ্রোহীরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে লাগলো।
সিরিয়ার অভ্যুত্থানে আল কায়েদার সুচনাঃ (২০১১–১২)
ইসলামিক স্টেট অফ ইরাকের আমীর আবু বকর আল বাগদাদী সিরিয়ান মুসলিমদের সাহায্য করার জন্য তার অন্যতম সেরা মুজাহিদ আবু মুহাম্মাদ আল গুলানিকে ISI এর অর্ধেক সম্পদ দিয়ে সিরিয়াতে জিহাদ করার জন্য পাঠান এবং এর নাম দেন জাবহাত আল নুসরাহ।
জাবহাত আল নুসরাহ সিরিয়ান বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে লাগলো কারন তারা ছিল সুন্নি (সুন্নি ও সালাফিরা সুন্নাহ অনুসরণ করে যা শিয়ারা করে না)। বিদ্রোহীরা দলত্যাগ করা সৈন্যদের কাছ থেকে ভারী অস্ত্র লাভ করে এবং অন্যান্য সিরিয়ান সৈন্যদের টাকা দিয়ে তাদের কাছ থেকে কিনে নেয়। ইসলামিক স্টেট অফ ইরাকের সাহায্যে জাবহাত আল নুসরাহও শক্তিশালী অস্ত্র ও বোমা তৈরি করতে পারে এমন মুজাহিদিন কে পান। এর ফলে নতুন গড়ে উঠা বিদ্রোহী সেনাদের নিয়ে গঠিত FSA (ফ্রি সিরিয়ান আর্মি) শক্তিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বড় বড় সফলতা পায়। আমি যে সময়ে এ লেখাটি লিখছি (নভেম্বর ২০১২ ) তখন সিরিয়ায় সরকার পক্ষ ও বিদ্রোহীদের মধ্যে ভারসাম্য দেখা যাচ্ছে।
পশ্চিমারা যখন বুঝতে পারল যে (২০১২ এর মধ্যবর্তী সময়) আসাদের সরকার আর বেশী দূর যেতে পারবে না, তখন তারা ঠিক করলো তারা সিরিয়ার উপর আধিপত্য চালু রাখার জন্য সিরিয়ার বিদ্রোহকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে সাপোর্ট করবে এবং এটা নিশ্চিত করবে যে ওই অভ্যুত্থানের শেষ ফলাফল হবে একটি গণতান্ত্রিক সিরিয়া যা পশ্চিমা স্বার্থ অনুযায়ী চলবে। (আরব লোকেরা একে অবসস ভণ্ডামিই মনে করবে যেহেতু প্রায় ৫০ বছর ধরে চলে আশা আসাদ সরকারকে কোন পশ্চিমা শক্তি সমালোচিত করেনি অথবা সুন্নিদের বিরুদ্ধে এতদিন চলে আশা নির্যাতন দেখে আসার পরও একে অগণতান্ত্রিক বা মানব অধিকার বিরোধী বলে আক্ষ্যা দেয় নি। আর এখন তারা তাদের রক্তে বয়ে যাওয়া আদর্শ অনুযায়ী সিরিয়া শাসন করার জন্য ইসলামিক অভ্যুত্থান কারীদের সমালোচনা করছে ।
আল কায়েদার লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে মুসলিম ব্রাদারহুড যেভাবে সহায়ক হলঃ
আল কায়েদার মতাদর্শ মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো নয়। আল কায়েদার ফোকাস হল মুসলিম বিশ্বকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত করা এবং একে অপসারণ করা। তারা বিশ্বাস করে এটা করার পরই পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক আধিপত্য দূর করে সত্যিকারের ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে। বর্তমানে মুসলিম ব্রাদারহুড পশ্চিমা আধিপত্যের ভিতরে থেকেই দেশ পরিচালনা করছে, যার কারনে তারা সত্যিকার ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর অনেক মানুষই এটা বুঝতে পারল যখন তারা দেখল মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড প্যালেস্টাইন স্বাধীনের ব্যাপারে সফল হতে পারছে না। গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইসলামপন্থী দলগুলোকে ক্ষমতার আসনে বসানো তাদের জন্য স্বল্প মাত্রার সফলতা নিয়ে আসবে।
পশ্চিমারা চেষ্টা করবে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো ইসলাম পন্থী দলগুলোর দীর্ঘ মেয়াদী ইসলামি এজেন্ডাগুলো সুনিপুণ ভাবে বাধা দিতে, যাতে তারা আরব মুসলিমদের সেই আশা পুরনে কখনও সফল হতে না পারে। প্রকৃতপক্ষে নতুন প্রজন্মের মুসলিম যুবকেরা যাদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান আছে (দ্বীনের ব্যাপারে তাদের অভিব্যক্তি দেখে যা বুঝা যায়), তারা আল কায়েদার সাথে যুক্ত দলের দিকে ঝুকে পড়বে – যারা প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন করে এখানে ও পুরো বিশ্বে ইসলামিক শারিয়াহ প্রতিষ্ঠা করতে চায় (অর্থাৎ খিলাফাহ কায়েম করতে চায়)।
আরও সোজাভাবে বলতে গেলে, মোডারেট ইসলাম পন্থী সরকার বা গণতান্ত্রিক সরকার যারা কিছু নির্দিষ্ট ইসলামিক ব্যাপারে জনগণকে স্বাধীনতা দেয়, যা কিনা মুসলিমদের গতানুগতিক ইসলাম অনুভব করতে দেয়, এর দ্বারা তারা বুঝতে পারবে যে মুসলিম ব্রাদারহুড টাইপ সরকার পুরোপুরিভাবে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করছে না; এর ফলে তারা আল কায়েদার দিকে ঝুকে পড়বে যাদের মধ্যে আদর্শিক ইসলামিক খিলাফতের প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তবিক অর্থেই অনুপ্রেরণা রয়েছে।
এর কারনে জায়নিস্টদের প্ল্যান উভয়সংকটের মধ্যে পড়েছে – হয় তাদের মুসলিম ব্রাদারহুডের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার ব্যাপারে লড়াই করতে হবে, যার কারনে লোকেরা দ্রুত আল কায়েদার সাথে যোগ দিবে অথবা তারা মুসলিম ব্রাদারহুডকে তাদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগুতে দিবে, যা মুসলিমদেরকে আল কায়েদার খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার আইডিয়ার সাথে একত্রিত করবে।
সিরিয়া : নতুন আফগানিস্তানঃ
সিরিয়া ৮০ ‘র দশকের আফগানিস্তানে রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রের মতো পরিনত হল, যেখানে বিশ্বের শক্তিগুলো একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলো এমন একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য হবে, অপরদিকে ৮০ ‘র দশকের পাকিস্তানের ভুমিকায় অবতীর্ণ তুরস্ক পালিয়ে আশা আফগানদের আশ্রয় দিবে। বিদ্রোহীরা তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ইসলামের দিকে ঝুকিয়ে নিল (পুরো বিশ্ব তাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করার পর)।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আশা মুজাহিদিনদের কারনে এ সম্ভাবনা দেখা গেল যে মুজাহিদিনের মাধ্যমে সিরিয়াতে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে এবং আমেরিকা অথবা ইসরাইল সন্ত্রাস দূরীকরণের দোহাই দিয়ে তাকে আক্রমণ করতে যাবে। আর এটা তো জানাই আছে যে ইসরাইল – আমেরিকা জোট ইতিমধ্যে ইসলামিক স্টেট অফ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। ইহুদিদের ধর্ম গ্রন্থেই এই ভবিষ্যৎ বাণী উল্লেখ করা আছে যে দুর্নীতি পরায়ণ ইসরাইলের সাথে ইসরাইলের উত্তরের এক লোকের সাথে সংঘর্ষ ঘটবে এবং শেষ বিজয় হবে পাহাড়ি লোকদের। (ভবিষৎবাণীর অধ্যায়)।
যে দেশগুলোতে আমেরিকা এক যোগে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সেগুলো হল ইরাক, ইয়েমেন, আফগানিস্তান এবং অতি শীঘ্রই সিরিয়া।
এই দেশগুলো আন্তর্জাতিক ইসলামিক জিহাদের পুনরজাগরনের আসল কারন হতে পারে যা পরবর্তীতে শেষ যুগে সংঘটিত যুদ্ধের দিকে গড়াবে (যার ব্যাপারে মুসলিম,খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে বলা আছে) যার ফলে অবৈধ ইসরাইলের ধ্বংস হবে।
পরিশেষে বলা যায়, আমেরিকা মুসলিমদের বিরুদ্ধে এক লোভনীয় যুদ্ধ শুরু করার মাধ্যমে নিজেকে এবং ইসরাইলকে (জাকে সে রক্ষা করতে খুব ইচ্ছুক ) ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে।
আরব বসন্ত এবং আইএসের উত্থানঃ
গত চার বছর ধরে আরবরা সীমাহীন দুর্ভোগের অতলগহ্বরে বাস করছে। তাদের বহুল আলোচিত ‘আরব বসন্ত’ সুখের দিনের সম্ভাবনা জাগিয়ে শেষ পর্যন্ত অপ্রত্যাশিত দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। আরব বসন্তে আক্রান্ত বেশির ভাগ দেশেই প্রায় একই অবস্থা বিরাজ করছে। স্বপ্নময় বিপ্লব প্রথমে পরিণত হয় বিরোধে, তা থেকে সৃষ্টি হয় সঙ্ঘাত এবং সেটা হয়ে পড়ে যুদ্ধ। এই নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থায় লণীয় ধরনের নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য ও অদ্ভুত সব চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পুরো অঞ্চলে এসবের প্রবল উপস্থিতি ও প্রভাব দেখা যাচ্ছে, তারা সীমান্তগুলো মুছে দিয়েছে, কয়েক দশক ধরে যে কৌশলগত ভারসাম্য বিরাজ করছিল, সেটাকে বিলীন করে দিচ্ছে।
আরব বসন্ত-পূর্ব আমলে অরাষ্ট্রীয় কুশলীদের (অ্যাক্টর) প্রধানত হামাস, হিজবুল্লাহ ও আলকায়েদার মতো ইসলামি আন্দোলনগুলোর ভূমিকা ছিল সীমিত। অবশ্য নতুন অরাষ্ট্রীয় কুশলী এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করার আগে ইসলামি আন্দোলন-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করা জরুরি।
প্রথমত, এসব আন্দোলনকে রাজনৈতিক ইসলাম বা উদার ইসলাম হিসেবে অভিহিত করাটা স্রেফ বর্ণনামূলক পরিভাষা, ধর্ম হিসেবে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম একটি ব্যাপকভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তমূলক ধর্ম, অন্য কারো ভূমিকা ছাড়াই কোনো বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারে। ফলে ইসলামের বিভিন্ন ধরন আছে, এমনটা বলা হলে ‘অ-উদার’ ইসলামের মতো অনেক কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে বলে ভুল ধারণা দিতে পারে।
কেউ কেউ যুক্তি দেখাতে পারেন, এ ধরনের পরিভাষা প্রয়োগ আসলে স্রেফ ‘সৃষ্টিশীল’ বিষয়, বিভিন্ন ইসলামি গ্র“পের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে কাজে লাগতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, পাশ্চাত্যের অনেক শক্তি ‘উদার ইসলামে’ এমন কোনো গ্রহণযোগ্য পরিভাষা পেতে পারে, যার মাধ্যমে সে নির্দিষ্ট গ্র“পগুলোর সাথে ‘কাজকাম’ চালিয়ে যেতে পারে। কাজ চালিয়ে নেয়ার অর্থ ব্যাপক। এ দিয়ে মৌলিক ও নিয়মিত যোগাযোগ থেকে শুরু করে জোট বাঁধা এবং অভিন্ন স্বার্থ ও এজেন্ডা নির্ধারণও হতে পারে। আবার অনেক ইসলামি গ্র“পও উদার ইসলাম কিংবা রাজনৈতিক ইসলাম হিসেবে নিজেদের পরিচিত করতে কুণ্ঠিত হয় না। সহিংস পন্থায় ল্য অর্জনে নিয়োজিত গ্র“পগুলো থেকে নিজেদের পার্থক্য বোঝাতে তারা এই পরিভাষাটি ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ‘উদার’ পরিচয় দিয়ে এসব গ্র“প অনেকটা বৈধতা পেয়ে থাকে, এর মাধ্যমে তারা তাদের ল্য অর্জনে নিজ নিজ সমাজে আরো স্বাধীনভাবে কাজ করতে সম হয়।
সম্ভবত এসব গ্র“পকে ‘ইসলামকেন্দ্রিক আন্দোলন’ হিসেবে অভিহিত করাটাই হতে পারে অনেক বেশি নির্ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ তারা একটিমাত্র ল্যই পোষণ করে : ইসলামি শাসনে ফিরে যাওয়া তথা শরিয়ার আইন কার্যকর করা। পার্থক্য কেবল সময়ের।
আবার অরাষ্ট্রীয় কুশলীদের বিষয়ে আসা যাক। যে কেউ স্বীকার করে নেবে যে, আরব বিপ্লবের পর তাদের ভূমিকা হয়েছে অনেক বেশি প্রকট। তারা এখন এ অঞ্চলের অনেক প্রশাসন ও সরকারের ভূমিকাকেও ছাপিয়ে গেছে। তারা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকপর্যায়ে সুনির্দিষ্ট নীতি ও এজেন্ডা চাপিয়ে দিতে শুরু করেছে। প্রতিটি আঞ্চলিক সম্মেলন ও আন্তর্জাতিক সভায় তারাই সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। এসব অ্যাক্টরের আত্মপ্রকাশে পুরো অঞ্চল অন্য দিকে ঘুরে গেছে।
অনেক বিধিনিষেধ গুঁড়িয়ে গেছে, একের পর এক দেশে তারা ঢুকে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে এখন বিশুদ্ধবাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মুরতাদ, কাফির, নাস্তিক শব্দগুলো হরদম ব্যবহৃত হচ্ছে। যেকোনো সময় এসব কুশলী গত শতকের (১৯১৬ সালে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মধ্যে সম্পাদিত সাইকিস-পিকট চুক্তির মাধ্যমে, উসমানিয়া তুর্কি সাম্রাজ্য তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। আরবদের নানা প্রলোভনে বশ করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে নিয়োজিত করেছিল) আঁকা প্রচলিত রাজনৈতিক সীমান্ত মুছে দিতে পারে।
তারা এবং তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের অনেক নাম : আলকায়েদা, আননুসরা ফ্রন্ট, দায়েশ কিংবা আইএসআইএস বা আইএস, হুথি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের আত্মপ্রকাশে মনে হচ্ছে, কোনো পরিসীমা বা সীমান্ত নেই। বলা হয়ে থাকে, তারা এমন অত্যাধুনিক সংগঠন ধারণ করে আছে, যা তাদের সদস্য বা রিক্রুটের সংখ্যাকে অনেক গুণ ছাড়িয়ে গেছে।
অন্য কথায়, তাদের সদস্যসংখ্যায় কোনোভাবেই এ ধরনের সংপ্তি সময়ে নজিরবিহীন ‘অর্জন’ প্রতিফলিত হচ্ছে না। এই অদ্ভুত সমীকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে তাদের পরিচিত ও অপরিচিত মিত্রদের নেটওয়ার্ক। তারাই তাদের অর্থ, কৌশলগত সমর্থন ও অস্ত্র দিচ্ছে। এসব মিত্র থাকছে স্পটলাইট থেকে অনেক দূরে। ইরাক ও সিরিয়ার পরিস্থিতি এক দিকে জটিল স্বার্থ ও সম্পর্ক এবং অন্য দিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইতস্ততার চোখে পড়ার মতো উদাহরণ। অনেক আঞ্চলিক শক্তি অন্যান্য ফ্রন্টের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি হঠাৎ বদলাচ্ছে কিংবা হিজবুল্লাহ বা পিকেকে কিংবা এমনকি আসাদ সরকারকে দুর্বল করার ল্েয এসব অরাষ্ট্রীয় কুশলীদের সমর্থন দিচ্ছে কিংবা তাদের দেখেও না দেখার ভান করেছে। একইভাবে হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিতকারী পাশ্চাত্যের শক্তিগুলো তাদের অপছন্দনীয়দের তাড়াতে এসব কুশলীর সিরিয়ায় প্রকাশ্য ভূমিকার প্রতি মৌনসম্মতি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এই শক্তিকে ব্যবহার করার সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে। সে তার আরব মিত্রদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছে, তাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করেছে।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি যে রাশিয়ার অর্থনীতিকে (এর ফলে তেহরান প্রধান তেল রফতানিকারকে পরিণত হবে, পরিণতিতে তেলের দাম কমে যাবে) তিগ্রস্ত করবে সে ব্যাপারে দেশটি পুরোপুরি সচেতন থাকলেও তার কিছু করার নেই। সে ইরানের প্রধানত অরাষ্ট্রীয় কুশলীদের সাথে ইরানের সম্পর্ক এবং নেটওয়ার্ক সম্পর্কে ভালোভাবেই জানে।
আশ্চর্য বিষয় হলো এবং অরাষ্ট্রীয় কুশলীদের অস্তিত্ব আঞ্চলিক আতঙ্ক আর নতুন সাইকিস-পিকট চুক্তি নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা করতে তাদের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও যে-কেউ বুঝতে পারছে যে, পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত সে দিকেই যাচ্ছে। আমেরিকা আইএসআইএসের ওপর হামলা চালানোর মধ্যেই গ্র“পটি ইরাক ও সিরিয়ার বিপুল এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। মজার ব্যাপার হলো, মার্কিন হামলার আগে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা ছিল অনেক কম। আইএসআইএসের যোদ্ধাদের আরো বেশি আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত এবং প্রশিতি মনে হচ্ছে, তাদের মিডিয়া কর্মদতা অনেক বেড়েছে। আইএসআইএসের উপর্যুপরি সাফল্য অন্যদেরও এই মডেল অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এর ফলে কোনো আরব রাজধানীই সুরতি নয়, বিশেষ করে তথাকথিত আরব বসন্তের ঘটনাবলির পর।
যদিও অনেক বিশ্লেষক এসব কুশলীর বেশির ভাগের যে পরিস্থিতিতে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এবং তাদের প্রকৃত ল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং অনেক অনুসন্ধানে এসব গ্র“পের কার্যক্রমে সন্দেহজনক বিষয়বস্তু দেখা গেছে, তবুও বলা যায়, অঞ্চলটি অনিচ্ছাকৃতভাবে তিকর অবস্থার দিকেই পা বাড়াচ্ছে।
অরাষ্ট্রীয় এসব কুশলীর অস্তিত্ব এবং কার্যক্রম মূল্যায়নের পর এ কথা অনেকে হয়তো বলবে যে, তারা ইসলামের ভাবমূর্তি যে নষ্ট করছে তা নিশ্চিত। দ্বিতীয়ত, ইসরাইলকে প্রতিরোধ করার জন্য আরব জনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় অনেক অরাষ্ট্রীয় কুশলী এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। তৃতীয়ত, কয়েক দশক ধরে এ অঞ্চলে কোণঠাসা হয়ে থাকা ইসরাইল এখন বলীয়ান হয়ে উঠেছে। তারা এসব অ্যাক্টরের দরজা দিয়ে আঞ্চলিক গতিশীলতার জগতে প্রবেশ করছে। আরো বিস্তারিতভাবে বললে বলতে হয়, আরব বসন্তে ইসরাইল কোনোভাবেই তিগ্রস্ত হয়নি। বরং অরাষ্ট্রীয় কুশলীদের আত্মপ্রকাশে তারা তিন স্তরে লাভবান হয়েছে।
প্রথমত, তেল আবিব সরকার অভিন্ন আতঙ্কের কথা বলে অনেক আরব শাসকের সাথে সম্পর্কের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে ইরান ও হিজবুল্লাহর কথা বলে। ইসরাইলের প্রতি হুমকি হিসেবে থাকা ইরাক ও সিরিয়ার মতো ঐতিহ্যবাহী আরব রাষ্ট্রগুলো দুর্বল হয়ে পড়াতেও তেল আবিব লাভবান হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং ফিলিস্তিনে তাদের চলমান উপনিবেশ দখলদারিত্ব থেকে দৃষ্টি চলে যাওয়াতেও ইসরাইল উপকৃত হয়েছে।
আরব বসন্তের চার বছরের সমীকরণঃ
শেষ হলো আরব বসন্তের চার বছর। বিগত চার বছরে আরব দেশগুলোতে ঘটে গেল এমন কিছু ঘটনা যা মধ্যপ্রাচ্যের বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসেও ঘটেনি।
আরব বসন্তের ঢেউ সরাসরি এসে আছড়ে পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশে । যার ফলে তিউনেশিয়া, মিশর, ইয়েমেন, বাহারাইন, লিবিয়া ও সিরিয়ার মতো দেশের প্রভাবশালী শাসকদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয়েছিল।
আরব বসন্তে প্রায় এক লক্ষ ৬৯ হাজার তিন শত সাতজন থেকে এক লক্ষ ৭৪ হাজার তিন শত ৩৯ জন লোক নিহত হয়।
তিউনেশিয়া: আরব বসন্তের সূত্রপাত হয়েছিল তিউনেশিয়ায়। স্বৈরাচারী শাসক বেন আলীর দুঃশাসনের ফলে এই দেশে বেকারত্বের হার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এর প্রতিবাদে এক যুবক প্রকাশ্য রাস্তায় শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহুতি দেয়। এর প্রতিবাদেই লোকজন বেন আলীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে পড়ে। সূচিত হয় আরব বসন্ত।
২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারী বেন আলী সৌদি আরবে পালিয়ে যান। আরব বসন্তের প্রথম সাফল্য এটিই। তিনি প্রায় ২৪ বছর তিউনেশিয়া শাসন করেন।
বেন আলীর পতনের পর ক্ষমতায় আসে ইসলামিক দল ‘ইনাহদাহ’। জনগণ আবারও ইনাহদাহ দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনলে সম্প্রতি তারাও পদত্যাগ করে। তিউনেশিয়ার আপামর জনতা এখন নতুন নির্বাচনের অপেক্ষায়।
তিউনিশিয়ায় স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে প্রায় ৩৩৮ জন নিহত হয়।
মিশর: আরব বসন্তের দ্বিতীয় প্রভাব পড়ে মিশরে। আরব বসন্ত হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের ইতি ঘটায়। এতে কমপক্ষে ১৭ শত মিশরীয় প্রাণ হারায়।
তারপরও গত তিন বছর মিশরের রাজনৈতিক অবস্থা উত্তাল ছিল। বিশ্ববাসী দেখেছে একজন স্বৈরশাসককে উৎখাতের পর কিভাবে আরেক স্বৈরশাসকের উত্থান ঘটে।
হোসনি মোবারকের পর মিশরে অনুষ্ঠিত হয় ইতিহাসের প্রথম নির্বাচন। এতে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মুহাম্মদ মুরসি।
তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, মিশর থেকে সেক্যুলারিজম দূর করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করাসহ বিভিন্ন আভিযোগ আনা হয়। শুরু হয় তাকে উৎখাতের আন্দোলন। আবারো উত্তাল হয়ে ওঠে তাহরির স্কয়ার। ২০১৩ সালের ৩ জুলাই তাকে উৎখাত করা হয়।
বর্তমানে মিশরে হোসনি মোবারক ও মুহাম্মদ মুরসি- দুজনেরই বিচার কার্যক্রম চলছে।
এতে মিশরীয় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি এখন জাতীয় বীর।
মিশরীয়রা এখন আশায় বুক বাধছে নতুন একজন প্রেসিডেন্ট দেখার আশায় যে সমস্ত মিশরীয়দের আশা আকাঙ্ক্ষা পুরন করতে পারবে।
ইয়েমেন: আরব বসন্তের পরবর্তী আসর বসে ইয়েমেনে। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে জনগণ ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বৈরশাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়। সালেহ প্রায় ৩৪ বছর ইয়েমেন শাসন করেন।
যদিও ইয়েমেন দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে স্বৈরশাসক সালেহকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়, তবুও সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে এখনও তাদের বহুপথ পাড়ি দিতে হবে।
ইয়েমেনের সমাজ রাজনৈতিকভাবে, জাতিগতভাবে বিভক্ত। দারিদ্র এখনও সেখানে প্রধান সমস্যা। আরেকটি সমস্যা হলো তালেবানের উপস্থিতি।
আরব বসন্তে ইয়ামেনের প্রায় ২ হাজার মানুষ মারা যায়।
বাহারাইন: মধ্যপ্রাচ্যের ছোট একটি দেশ বাহারাইন। লোকসংখ্যা মাত্র ১৭ লক্ষ। ২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইয়েমেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে যা এখনও অব্যাহত আছে।
বাহারাইনের মূল সমস্যা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শিয়া সম্প্রদায়ের হলেও শাসক সুন্নি সম্প্রদায়ের। সেখানকার সমাজও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। বাহারাইনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাটি রয়েছে।
রাজতন্ত্র উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই বাহারাইনের আন্দোলন কর্মীদের মূল লক্ষ্য। এপর্যন্ত বাহারাইনে প্রায় ১২০ জন আন্দোলনকর্মী প্রাণ হারিয়েছে।
লিবিয়া: এরপর আরব বসন্তের আরেকটি ঝড় ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ায়। কর্নেল মুয়াম্মর গাদ্দাফির দীর্ঘ ৪২ বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটাতে আন্দোলন-সংগ্রামে ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
২০১১ সালের ২০ অক্টোবর সিরাতে গাদ্দাফিকে গ্রেফতারের পর হত্যা করা হয়। তার তিন ছেলে আরব বসন্তে মারা যায়। বাকী দুজন এখন বিচারের সম্মুখীন।
লিবিয়া সংকটের সময় সেখানে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে। বিশ্বসম্প্রদায়ের সহায়তায় লিবিয়ান আন্দোলনকর্মীরা সফল হয়। বর্তমানে লিবিয়ার সমাজ বহু গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই সপ্তাহে বিদ্রোহীদের দমনে ব্যর্থ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী আলী জিদানকে বরখাস্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার ঘটনাই মিসরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিরতা প্রমাণ করে ।
সিরিয়া: সিরিয়ায় আরব বসন্ত এখনও সফল হয়নি। সিরিয়রা পারেনি বাশার পরিবারের দীর্ঘ ৪৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটাতে। উপরন্ত বাশার বাহিনী এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ সিরিয়কে হত্যা করেছে। কয়েক মিলিয়ন লোক উদ্বাস্তু হয়েছে। এখনও বন্দী আছে প্রায় কয়েকটি শহরের বাসিন্দা।
বাশার বাহিনী সিরিয়ায় সারিন গ্যাস ব্যবহার করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় সিরিয়া থেকে রাসায়নিক গ্যাস অপসরণের কাজ চলছে।
ইতিমধ্যে বাশার আল আসাদ নতুন নির্বাচনের লক্ষ্যে সংসদে আইন পাস করেছে। যা সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে দিয়েছে। কারণ নতুন আইনের আওতায় বিদ্রোহী কোনো নেতা নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না। তাছাড়া সিরিয়ার পরিস্থিতি যে জটিল রূপ লাভ করেছে তাতে মনে হয় না তা সহজে সমাধান হবে। এসব দেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি-আরব, কুয়েত, ইরান ইত্যাদি দেশেও আরব বসন্তের প্রভাব পড়েছে।
যেসব দেশে বিক্ষোভ চলছেঃ
১.আলজেরিয়া ২.বাহরাইন ৩.জিবুতি ৪.মিশর ৫.ইরান ৬.ইরাক ৭.জর্ডান ৮.কুয়েত ৯.লিবিয়া ১০.মৌরিতানিয়া ১১.সিরিয়া ১২.সোমালিয়া ১৩.সুদান ১৪.তিউনিসিয়া ১৫.ইয়েমেন ১৬.মরক্কো ১৭.পশ্চিম সাহারা ১৮.ওমান ১৯.সৌদি আরব ২০. কাতার।
আরব বসন্ত ও উন্নয়ন প্রশ্নে আরব রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান মূল্যায়নঃ
আরব নিউজ : ক্ষুদ্র পরিসরে ইরানে একটি বিপ্লব ঘটে ১৯৫০ দশকে। বলা হয় ঐ বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। ইরানের প্রধানমন্ত্রীত্ব ছিল তার কাম্য। ইরানী তেলশিল্পে বৃটেনের অংশগ্রহণ মোসাদ্দেক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলেই তার সরকারের পতন ঘটানো হয়- এই দাবি বিশ্লেষকদের।
ইরানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয় এবং বিদেশে নির্বাসিত ইরানী শাহ রেজা পাহলবি একটি অভ্যুত্থান পরবর্তীতে ইরানে ফিরে আসেন। বাকিটা ইতিহাস। উল্লেখ্য বিষয় হচ্ছে, শুধুমাত্র তেল উৎপাদন স্থাপনাগুলোকে ঘিরে যে দাঙ্গা শুরু হয়, তাতে সরকার পরিবর্তনের দাবি ছিল না। তেল সংক্রান্ত সমঝোতাগুলোয় কিছু মৌলিক পরিবর্তন চেয়েছিল বিক্ষোভকারীরা। তাদের দাবি ছিল, তেল সমঝোতা ইরান সম্পন্ন করুক সৌদি তেলচুক্তির অনুসরণে।
অনেকে মনে করেছিলেন ইরানে সংঘটিত স্বল্পস্থায়ী বিদ্রোহের পেছনে দাহরানের হাত ছিল। দাহরান হচ্ছে সৌদি আরবের জ্বালানি রাজধানী। এই অভিযোগ মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এই অভিযোগ বেবুনিয়াদ ও যুক্তিহীন।
কিন্তু একের পর এক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এরপরেও প্রকাশ পেতে থাকে। ইত্যবসরে নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধকার টমাস ফ্রেইডম্যান তার ‘ডিড দুবাই ডু ইট’ নামের লেখায় আরব স্প্রীং সম্পর্কিত কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। লেখাটি বেরোয় ২০১৪, ১৮ নভেম্বরে। ফ্রেইডম্যানের মতে, দুবাইয়ের উন্নয়ন সাফল্যই ছিল বিভিন্ন দেশে আরব জাগরণ শুরুর প্রেরণা স্বরূপ।
অন্য অনেকে বলতে চেয়েছিলেন, আরব বসন্ত সংঘটিত হয় গণতন্ত্রের দাবিতে। তারা আরও বলেন, সবগুলো উপসাগরীয় দেশে আরব বসন্ত। ছড়িয়ে পড়বে- কেননা রাজতন্ত্রশাসিত উপসাগরীয় দেশগুলো কোনো একটিতেও গণতন্ত্রের চর্চা নেই।
কিন্তু ভিন্ন বিশ্লেষণ তুলে ধরেন ফ্রেইডম্যান। তিনি বলেন, আরব বসন্ত গণতন্ত্রের দাবিতে ঘটেনি। ঘটে জীবনমান উন্নয়নের দাবিতে।
আরব বসন্ত এক সময় উত্তাল হয়েছিল যে আরব দেশগুলো, আজ তারা ভগ্নদশায়। আরব জাগরণ পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাওয়াও আজ তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে লিবিয়া, ইয়েমেন, ইরাক ও সিরিয়ার দিকে তাকালে।
১৯৫০, ৬০ ও ৭০ দশকে মিসর, সিরিয়া ও ইরাকের মত অধিকাংশ আরব প্রজাতন্ত্রে শাসন ক্ষমতায় আসীন দেখা যেতো আজীবন প্রেসিডেন্টদের।
রাজা, আমীর, শেখ ও সুলতান শাসিত উপসাগরীয় দেশগুলোকে পশ্চাদপদ বলে অবজ্ঞা উপহাস করতেন ঐ প্রেসিডেন্টরা। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তা বলে না। দেখা যায়, তথাকথিত আরব প্রজাতন্ত্রগুলোর নেতাদের তুলনায় অনেক বৈধ ব্যবস্থায় ক্ষমতায় আসীন থাকেন উপসাগরীয় দেশগুলোর শাসকরা। উপসাগরীয় দেশগুলোর শাসকরা দেশ শাসন করে এসেছেন বহু শত বছর ধরে। পক্ষান্তরে আরব রিপাবলিক নেতারা ক্ষমতায় আসীন হন সামরিক অভ্যুত্থানের পরবর্তীতে। আরও লক্ষণীয়, বিপুল সম্পদের অপচয় ঘটিয়েছেন প্রজাতান্ত্রিক নেতারা কিন্তু দেশের উন্নয়ন ঘটেনি। অন্যদিকে উপসাগরীয় শাসকরা প্রচার-আড়ম্বরে না মেতে বেশ নীরবেই দেশ নির্মাণে ব্রতী থেকেছেন এবং দেশের জনগণকে আপন বানিয়েছেন।
উপসাগরীয় দেশগুলোর স্থিতিশীলতা নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি সম্বন্ধে পুরোপুরি ভুল ধারণা- কিছু বিশ্লেষক পোষণ করে থাকেন। তারা মনে করেন, বাইরের দুনিয়ায় বয়ে চলা পরিবর্তনের হাওয়া উপসাগরীয় দেশগুলোয় প্রবেশ করতে পারে না। ঐ দেশগুলো বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নিশ্ছিদ্র বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয় বলে।
বিশ্লেষকদের ঐ ধারণা রীতিমতো ভ্রান্ত প্রমাণিত হলো বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যু পরবর্তীতে সৌদি আরবে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটনার মধ্য দিয়ে।
অনেকেই হয়তো ধরে নিয়েছিলেন বাদশাহ্র মৃত্যু পরবর্তীতে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকে ঘিরে সৌদি নেতৃত্বের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের সূত্রপাত ঘটবে অবশ্যম্ভাবীভাবে। তেমন কিছুই হয়নি। সৌদি প্রশাসন রয়েছে যেহেতু রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে, তাই শাসক ও শাসিতের মধ্যে উন্মুক্ত সম্পর্কের কথা অনেকে চিন্তা করতে পারেন না। শাসক ও শাসিতের মধ্যে স্বচ্ছ সুন্দর যোগাযোগ সৌদি আরবে সক্রিয় রয়েছে- অনেকে সে খবরই রাখেন না।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপে বসেন এবং নাগরিকদের অভাব-অভিযোগ সম্বন্ধে অবহিত হয়ে সৌদি নেতারা যথাবিহিত কর্তব্য নিরূপণ করে থাকেন। প্রজাতান্ত্রিক আরব দেশগুলোর নাগরিকরা শাসক ও শাসিতের এমন ধরনের নিয়মিত ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কামনা করে থাকলেও বাস্তবে তা ঘটতে দেখা যায় না। যায় না বলেই নানা অশান্তি-সংঘাতে জর্জরিত ও বিপর্যস্ত দেখতে পাওয়া যায় আরব প্রজাতন্ত্রগুলোকে।
সরকারি কর্মচারীদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ও অবসরভোগীদের দু’মাসের বোনাস পরিশোধের আদেশ জারি করেন দুই পবিত্র মসজিদের খাদেম বাদশাহ সালমান মাত্র কয়েকদিন হলো।
আরব বসন্ত’ আমাদের কী শিক্ষা দেয়ঃ
সারা আরব বিশ্বই এখন অশান্ত। তিউনেসিয়ায় বেকার কম্পিউটার গ্রাজুয়েট মোহাম্মদ বওউকুজিজির আÍহত্যার ঘটনা যে ‘ঢেউ’ সৃষ্টি করেছিল, তার রেশ এখনও আছে। তিউনেসিয়ায় বেন আলীর পতন হয়েছে। মিসরের হোসনি মোবারক এখন অন্তরীণ। লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। বাহরাইনে সৌদি সেনাবাহিনী প্রবেশ করে সংখ্যালঘু সরকারকে আপাতত টিকিয়ে রেখেছে বটে, কিন্তু অসন্তোষ সেখানে আছে। এই অসন্তোষ আছে ইয়েমেনে, আলজেরিয়ায়, সিরিয়ায় কিংবা জর্ডানেও। সারা আরব বিশ্বে হঠাৎ করে গণবিােভের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই গণবিােভকে সংগঠিত করছে তরুণ সমাজ, যারা ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে একের পর এক পরিবর্তন ডেকে আনছে আরব বিশ্বে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ‘প্রাগ-বসন্তের’ কথা জানেন। জানেন ‘ভেলভেট বিপ্লব’-এর কথাও। ১৯৬৮ সালের ‘প্রাগ-বসন্ত’ সাবেক চেকোস্লাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংস্কারের উদ্যোগ (ডুবচেকের নেতৃত্বে) ব্যর্থ করে দিয়েছিল। সেদিন সোভিয়েত ট্যাংক চেকোস্লাভিয়ার রাজধানী প্রাগে নেমেছিল। এর পর ১৯৮৯, সেই চেকোস্লাভাকিয়াতেই নাট্যকার ভাসলাভ হাভেলের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। সেই আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল পূর্ব ইউরোপের প্রতিটি রাষ্ট্রে। একে একে পতন ঘটেছিল পূর্ব ইউরোপের প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক সরকারের, ইতিহাসে যা চিহ্নিত হয়ে আছে ‘ভেলভেট রেভ্যুলেশন’ হিসেবে। এই ‘ভেলভেট রেভ্যুলেশন’ একটি বড় পরিবর্তন এনেছিল পূর্ব ইউরোপে। সেখানে সমাজতন্ত্রের বদলে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র চালু হয়েছে। এর ঠিক ২২ বছর পর সারা আরব বিশ্বে শুরু হয়েছে পালাবদল। আরব লীগভুক্ত ২২টি দেশে কোথাও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র নেই। সেখানে রয়েছে একনায়কতান্ত্রিক শাসন। গণতন্ত্রসূচকে এ দেশগুলোর অবস্থান অনেক নিচে। (যেমন ১৬৭টি দেশের মাঝে লিবিয়ার অবস্থান ১৫৮, সুদানের ১৫১, সিরিয়ার ১৫৩, ইয়েমেনের ১৪৬)। দুর্নীতিতেও এরা সেরা (১৭৮টি দেশের মাঝে মিসরের অবস্থান ১৩৮, লিবিয়ার ১৪৬, আলজেরিয়ার ১০৫, ইরাকের ১৭৫ ও মৌরিতানিয়ার ১৪৩)। আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই এসব দেশে। ১৯৬টি দেশের মাঝে ইয়েমেনের অবস্থান ১৭৩, তিউনেসিয়ার ১৮৬, সিরিয়ার ১৭৮, সুদানের ১৬৫ ও লিবিয়ার ১৯৩। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে পরিবর্তনটা কেন প্রয়োজন ছিল আরব বিশ্বে? ‘প্রাগ বসন্ত’ চেকেস্লোভাকিয়ার সমাজব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি বটে, কিন্তু পরিবর্তন এসেছিল ‘ভেলভেট রেভ্যুলেশন’-এর মধ্য দিয়ে। আজ আরব বিশ্বও সেই পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে। ইতিমধ্যে ‘জেসমিন বিপ্লব’ ও ‘রেভ্যুলেশন ২.০’ তিউনেসিয়া ও মিসরে পরিবর্তন ডেকে এনেছে। ইতিহাসের এটাই অনিবার্যতা।
সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত ঐতিহাসিক জ্যাকব বুরচার্ডের মতে, ইতিহাসের শিা হচ্ছে, কোন শক্তি যখন উন্নয়ন বা নতুন সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সে শক্তির পতন অনিবার্য। আরব বিশ্বে এমনটিই হয়েছে। শাসকচক্র সেখানে যুগের সঙ্গে তাল রেখে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তরুণ সমাজ ছিল বেকার। এদের জন্য কর্মসংস্থান করা যায়নি। সারা আরব বিশ্বে ২৫ বছরের নিচে যে জনগোষ্ঠী তা মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক (মিসরে ৫২.৩ ভাগ, সিরিয়ায় ৫৫.৩ ভাগ, ইয়েমেনে ৬৫.৪ ভাগ, তিউনেসিয়ায় ৪২.১ ভাগ, লিবিয়ায় ৪৭.৪ ভাগ)। এই জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির সংস্থান করা যায়নি। এরাই আজ ‘আরব বসন্ত’-এর নেতৃত্ব দিচ্ছে, এই আরব বিপ্লব আমাদের জন্য অনেক চিন্তার কারণ।
এক. আরব বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ তরুণ সমাজ, যাদের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এদের একটা বড় অংশ বেকার। পরিকল্পনাহীনভাবে আমরা গ্রাজুয়েট তৈরি করছি। কিন্তু চাকরির সংস্থান করতে পারছি না। ৩২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সেই সঙ্গে আরও দুটো মেরিটাইম ও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় আমরা প্রতিষ্ঠাকরেছি। হাজার হাজার মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বেরোচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোচ্ছে লাখ লাখ। এ সমাজে আমাদের এত মাস্টার্স ডিগ্রিধারীর প্রয়োজন নেই। শিাব্যবস্থার সঙ্গে যারা জড়িত তারা বিষয়টি চিন্তা করেন না। উচ্চশিা সীমিত হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন বাজার উপযোগী শিাব্যবস্থা। সেদিকে না গিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য আমাদের সন্তানদের আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছি। এরা পাস করে সমাজের বোঝা হয়ে যাচ্ছে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বেকার থাকছে। এরা যে কোন সরকারের জন্যই একটি ‘থ্রেট’, যেমনটি আমরা আরব বিশ্বে ল্য করি।
দুই. এই তরুণ সমাজকে প্রশিণ দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থান করা যায়। এ জন্য দরকার সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। আমলা নির্ভর আমাদের যে সমাজব্যবস্থা, তাতে আমলারা ‘বাজার অনুসন্ধান’ এ বিদেশে সফরে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু সেই ‘বাজার’ আজও সৃষ্টি হয়নি। লিবিয়া থেকে হাজার হাজার কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। সরকার প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। এটা নিয়েও কথা আছে। সবচেয়ে বড় কথা, ৫০ হাজার টাকা কোন সমাধান নয়। এদের জন্য স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। -এ জন্য দরকার বড় বিনিয়োগ।
তিন. অর্থনীতি কোন আশার কথা বলে না। মুখ থুবড়ে পড়ছে অর্থনীতি (যুগান্তর, ৬ এপ্রিল)। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দেখা দিয়েছে অস্থিরতা আর বৈশ্বিক প্রোপট এ অস্থিরতার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থনীতির এ নাজুক পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। তাদের আশংকাÑ সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি, তারল্য সংকট, বিনিয়োগে বেহাল অবস্থা, প্রকট অবকাঠামো সমস্যা, নাজুক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি, দুর্নীতির উচ্চমাত্রা আর চাঁদাবাজির কারণে অধোগতিতে চলবে অর্থনীতির ধারা (ওই)। অর্থনীতির এই অবস্থা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করবে।
চার. শেয়ারবাজার কেলেংকারি নিয়ে সরকার একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে আছে। সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। একই সঙ্গে তারা অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করেছে। এই রিপোর্টটি আদৌ কোনদিন প্রকাশিত হবে কিনা, তা নিয়েও শঙ্কা আছে। ইতিমধ্যে উচ্চ আদালত থেকে এ ব্যাপারে একটি রুলও ইস্যু হয়েছে। এই শেয়ারবাজার কেলেংকারিতে সরকারের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হয়েছে, তা আর বলার অপো রাখে না। মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে শেয়ারের সূচক যখন ৬০০ পয়েন্ট নিচে নেমে গিয়েছিল, তখন বুঝতে কারও বাকি থাকে না যে একটি শক্তিশালী অসাধু চক্র এর সঙ্গে জড়িত। সরকার কি তার দায় এড়াতে পারে? ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছে শেয়ার মার্কেটে। এদের অসন্তোষ সরকারের জন্য কোন শুভ সংবাদ নয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন মতায়, তখনও শেয়ারবাজার কেলেংকারি হয়েছিল। তখন তদন্ত কমিটি ৩৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। কিন্তু তাদের একজনেরও বিচার হয়নি। ২০১১ সালেও তদন্ত কমিটি কিছু দোষী ব্যক্তিকে কারসাজির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু আদৌ বিচার হবে কী! না হলে অসন্তোষ বাড়বেই।
পাঁচ. উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেেিত সরকার সংবিধান পরিবর্তনের ল্েয একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকলেও, বিএনপি তাতে অংশ নেয়নি। জাতীয় কমিটি বিএনপির সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখানেও সেই ‘বিরোধ’ রয়ে গেল। সংবিধান একটি জাতির, এটা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নয়। এখানে বিশেষ করে এ ধরনের জাতীয় প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের ন্যূনতম ঐকমত্য প্রয়োজন। চল্লিশ বছরে পা দিয়েও আমাদের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করল জাতি হিসেবে আমরা আজও বিভক্ত। বর্তমান প্রোপটে সরকার যদি একক উদ্যোগে সংবিধান সংশোধন করে, তাহলে তা বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়াবে মাত্র।
ছয়. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরকারের জন্য একটি ‘গলার কাঁটা’। বিশ্বব্যাপীই খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে এর প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে পরা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এখানে রয়েছে একটি অসাধু চক্র, যারা উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যের (চাল, তেল, চিনি, আটা) মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। বাণিজ্যমন্ত্রীর ‘হুমকিও’ এখানে ব্যর্থ। নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চমূল্য সরকারের জন্য বড় হুমকি।
সাত. অর্থনীতির মন্দার কারণে কৃচ্ছ্রসাধন যেখানে জরুরি, সেখানে সরকারি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ঘটছে। চাকরির ক্ষেত্রে (এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও) ‘প্রায়োরিটি’ পাচ্ছে সরকারি দলের লোকেরা। পদ্মা সেতু নির্মাণ এখন ঝুঁকির মুখে। বিদ্যুৎ যেখানে ‘প্রায়োরিটি’, সেখানে অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সর্বশেষ একটি প্রকল্পে দেশ নিরক্ষর মুক্ত করার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে ছাত্রলীগকে (কালের কণ্ঠ, ২১ এপ্রিল), যেখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার আলোকে দেশে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই।
বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক সুবিধাভুগিতা, রাজনৈতিকভাবে একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা আরব বিশ্বে ‘বিপ্লবের’ ডাক দিয়েছে, ‘আরব বসন্ত’-এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। ‘আরব বসন্ত’ থেকে শিা নেয়ার আছে অনেক কিছু। আমরা এ থেকে আদৌ কোন শিক্ষা নেব কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
সারসংক্ষেপঃ
‘আরব বসন্তে’র দোলায় মধ্যপ্রাচ্য অস্থিরতা ছড়িয়েছে কিন্তু স্থিতিশীলতা কিংবা সমৃদ্ধি আসেনি। মিসরে এক সরকারকে হটিয়ে আরেক সরকার সিংহাসনে বসেছে, লিবিয়া জুড়ে চলছে বিশৃঙ্খলা, গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ে মরছে সিরিয়া, দেশটির লাখ লাখ মানুষ ঘর ছেড়ে এখন খোলা আকাশের নিচে ঘুরছে। বাস্তবতা হচ্ছে ‘আরব বসন্ত’টা হলো পশ্চিমাদের রং দেয়া ‘রং বিপ্লব’ এর মহড়া।
স্নায়ু যুদ্ধ চলাকালে পশ্চিমাদের ইন্ধনেই ভেঙে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর সে সময়টাতেই পশ্চিমারা ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শাখা মেলার সুযোগ তৈরি করে।কিন্তু রাশিয়ার পুর্নজাগরণে তাদের এ যুদ্ধ ভেস্তে যায়। রাশিয়াকে বাদ দিয়ে পশ্চিমারা তাদের নজর ফেরায় মধ্যপ্রাচ্যের দিকে।
২০১১ সালটাতে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ও দ্বন্দ্ব বিস্তার লাভ করে। আর এ সুযোগটাকে মোক্ষম সময় হিসেবে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের কাজে লাগায় পশ্চিমারা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ছড়িয়ে আন্দোলন ও বিক্ষোভকে ‘আরব বসন্ত’ বলে প্রচার করে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো। আর এসব আন্দোলনে পশ্চিমা সরকারেরা হস্তক্ষেপ করে এবং তাদের স্বার্থের বিষয় মাথায় রেখে মধ্যপ্রাচ্যে উন্নয়ন কাজে বিনিয়োগ করে।
চলমান বিক্ষোভ ও আন্দোলনের মুখে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ না করে বরং তারা বিশৃঙ্খলার বীজই বপন করে যাচ্ছে।পশ্চিমাদের তৈরি করা ‘আরব বসন্ত’ কোন রদ-বদলতো আনতেই পারেনি বরং আরেক সংকটে পড়েছে মিসর, লিবিয়া ও সিরিয়া।
সংক্ষেপে বলা যায়, এই অঞ্চলের এখন নতুন সালাহউদ্দিনের মতো প্রকৃত নেতার দরকার। এই নেতাই পারেন, দুর্দশা, হানাহানি থেকে মধ্যপ্রাচ্যকে রা করতে। তিনিই পারেন ইসলামকে যথাযথভাবে তুলে ধরে এর মর্যাদা সমুন্নত করতে।
তথ্যসূত্র
১. Laub, Karin, “Libyan estimate: At least 30,000 died in the war”. San Francisco Chronicle, Associated Press
২. http://www.internetworldstats.com/af/tn.htm
৩. http://www.carnegieendowment.org/arb/?fa=downloadArticlePDF&article=20495
৪. Filiu, Jean Pierre, ‘The Arab Revolution: Ten Lessons from the Democratic Uprising’, Hurst & Company, London
৫. Middle East at Aljazeera English
৬. Middle East protests at BBC News
৭. Arab and Middle East protests live blog at The Guardian
৮. Middle East Protests at The Lede blog at The New York Times
৯. Middle East protests live at Reuters
১০. Unrest in the Arab World collected news and commentary at Carnegie Endowment for International Peace
১১. Issue Guide: Arab World Protests, Council on Foreign Relations
১২. Middle East protests collected news and commentary at The Financial Times
১৩. Rage on the Streets collected news and commentary at Hurriyet Daily News and Economic Review
১৪. Middle East Unrest collected news and commentary at The National
১৫. Middle East Uprisings collected news and commentary at Showdown in the Middle East
১৬. The Middle East in Revolt collected news and commentary at Time
১৭. The Shoe Thrower’s index, An index of unrest in the Arab world, The Economist, 9 February 2011
১৮. Interview with Tariq Ramadan: “We Need to Get a Better Sense of the Trends within Islamism”, Qantara.de, 2 February 2011
১৯. Tracking the wave of protests with statistics, RevolutionTrends.org
২০. http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=175210
২১. “Korotayev A., Zinkina J. Egyptian Revolution: A Demographic Structural Analysis. ”Entelequia. Revista Interdisciplinar” 13 (2011): 139–169″। Cliodynamics.ru। সংগৃহীত ২৮ অক্টোবর ২০১১।
-
Previous Post
Effective Email Marketing Strategies